Header Ads

অসমের সংখ্যালঘু, সংঘাত এবং ন্যায় প্ৰাপ্তির অধিকার


দিগন্ত শৰ্মা

দেশ বিভাজনের সময় এবং তার ঠিক পর থেকে ভারতবৰ্ষের বিভিন্ন প্ৰান্তে সংখ্যালঘুরা বিভিন্ন শক্তির দ্বারা নিৰ্যাতিত, বঞ্চিত এবং চরম অবজ্ঞার বলি হয়ে আসছেন৷ এই নিৰ্যাতন-অন্যায়-অবিচার-বঞ্চনার নিকৃষ্ট প্ৰতিছবি দেখা যায় উত্তর পূৰ্ব ভারতের অন্যতম অংগরাজ্য অসমে৷ স্বাধীনোত্তর কালে অসমে ধৰ্মীয় এবং ভাষিক সংখ্যালঘুরা এমন ভাবে নিপীড়নের বলি হয়েছিলেন যা বৰ্ণনাতীত৷ দেশ বিভাজনের সময় একাংশ লোক ভারতবৰ্ষ ত্যাগ করে পাকিস্তানে যায়৷ একাংশ পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে প্ৰবেশ করে৷ কিন্তু সেই সময়েও অবিভক্ত অসমের বিভিন্ন প্ৰান্তে ভাষিক সংখ্যালঘু এবং ধৰ্মীয় সংখ্যালঘুরা অত্যাচারের বলী হয়েছিলেন৷ উল্লেখ্য এখানে ধৰ্মীয় সংখ্যালঘু বলতে প্ৰধানতঃ মুছলিম, খ্ৰীষ্টান, শীখ, বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি ধৰ্মগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়েছে৷ অবশ্য একটু বিস্তত দৃষ্টিভঙ্গীতে৷ যাই হোক, অসমের ভাষিক সংখ্যালঘুর মধ্যে বৃহৎ সংখ্যাকেই বাংলাভাষী৷ এই বৃহৎ ভাষিক সংখ্যালঘুর জনসংখ্যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার চারভাগের এক ভাগ থেকেও বেশী৷ একই ভাবে অন্যান্য ক্ষুদ্ৰ ক্ষুদ্ৰ ভাষিক সংখ্যালঘু জনসমষ্টীও অসমে আছে৷ অন্যদিকে রাজ্যটিতে ধৰ্মীয় সংখ্যালঘুর মধ্যে ২০১১ সনের লোকপিয়ল অনুসারে মুসলিম ধৰ্মাবলম্বী লোকের সংখ্যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৩৪.২২, খ্ৰীষ্টান ৩.৭৪ শতাংশ, শিখ ০.০৭ শতাংশ, বৌদ্ধ ধৰ্মাবলম্বী ০.১৮ শতাংশ এবং জৈন ধৰ্মাবলম্বী ০.০৮ শতাংশ৷ কিন্তু দেখা গেছে স্বাধীনোত্তরকালে অসমে বিভিন্ন সংঘাতের বলি হয়েছেন বাংলাভাষী হিন্দু অৰ্থাৎ ভাষীক সংখ্যালঘু শ্ৰেণীর লোক এবং বাংলাভাষী তথা বঙ্গীয় মূলের মুসলিম অৰ্থাৎ ধৰ্মীয় সংখ্যালঘুর সম্প্ৰদায়ের লোক৷ কিন্তু প্ৰ উঠছে- বিভিন্ন শক্তির আক্রমণ-নিৰ্যাতনের বলি হওয়া এই সম্প্ৰদায়ের ভুক্তভোগীরা প্ৰকৃতাৰ্থে ন্যায় লাভ করেছেন কী ? ধৰ্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্ৰিক দেশ ভারতবৰ্ষের ন্যায়পালিকা বা রাষ্ট্ৰ ব্যবস্থা এই নিপীড়িত শ্ৰেণীকে ন্যায় প্ৰদানে সক্ষম হয়েছে কি ? বলাবাহুল্য যে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর ন্যায় লাভ করার ক্ষতিয়ানই প্ৰমাণ করে অসমের নিৰ্যাতিত ভাষিক ধৰ্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্ৰদায়ের প্ৰতি বঞ্চনার কথা৷

১৯৫০ সনের সংঘৰ্ষ :

স্বাধীনোত্তর কালে ১৯৫০ সনে নিম্ন অসমে সাম্প্ৰদায়িক সংঘাত সংঘটিত হয়৷ সেই সময়ের বরপেটা থেকে অবিভক্ত গোয়ালপারা জেলায় বিশেষ করে ধৰ্মীয় সংখ্যালঘুরাই ক্ষতিগ্ৰস্ত হয়েছিলেন৷ হিন্দু-মুসলিমের এই সাম্প্ৰদায়িক দাঙ্গা চলেছিল অনেকদিন ধরে৷ এই দাঙ্গার আড়ালের মূল কারণ ছিল তৎকালীন পূৰ্ব পাকিস্তানে সংগঠতি ব্যাপক সাম্প্ৰদায়িক সংঘৰ্ষ৷ পূৰ্ব পাকিস্তানে (বৰ্তমান বাংলাদেশে) সংঘটিত সংঘৰ্ষে ক্ষতিগ্ৰস্ত বা অত্যাচারের বলি হয়ে আসা হাজার হাজার হিন্দু সম্প্ৰদায়ের লোক অসমে প্ৰবেশ করে৷ অত্যাচারের বলি হয়ে আসা নিপীড়িত হিন্দু সম্প্ৰদায়ের লোকের মুখে অত্যাচারের কথা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অসমের পশ্চিম প্ৰান্তে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়৷ এই উত্তেজনা হঠাৎ মুসলিম বিদ্বেষী প্ৰতিক্রিয়া হয়ে প্ৰতিশোধ স্পৃহা জেগে ওঠে৷ ফলে সে সময়ের অবিভক্ত কামরূপ জেলা এবং গোয়ালপারা জেলার বিভিন্ন স্থানে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্ৰদায়িক সংঘৰ্ষ হয়৷ এই সংঘৰ্ষে সহস্ৰাধিক ধৰ্মীয় সংখ্যালঘুকে হত্যা করা হয়৷ বরপেটা জেলায় সেই সংঘৰ্ষের ভুক্তভোগী অনেক মুসলমান আজও রয়েছেন৷ বরপেটার কলগাছিয়ার চেনীমারী গ্ৰামের কলিমুদ্দিন, কলাগাঁও অঞ্চলের জয়নুদ্দিন সেই সংঘাতের সাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছেন৷ বালাগাঁওয়ের আবেদ আলীকে হত্যা করা হয়েছিল, অন্যদিকে আহত হয়েছিলেন বৰ্জুক আলী, মাবেদ আলী ভষ্মীভূত হয়েছিল অঞ্চলটির তিতাপানী, বগুলমারী, ক্ষুদ্ৰকুচি, কলাগাঁও, দাবনদিয়া ইত্যাদি গ্ৰাম৷ নিহত হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন৷ একই ভাবে ক্ষতিগ্ৰস্থ হয়েছিল গোয়ালপারা জেলার চাকলা, নাম্বারপারা, কোকিলা, মৌলবীপারা, শোলমারী ইত্যাদি গ্ৰাম৷ ভষ্মীভূত হয়েছিল কোকিলা হাইল৷ তাৎপৰ্যপূৰ্ণ বিষয় হলো এই সাম্প্ৰদায়িক সংঘাত তথা পূৰ্ব পাকিস্তান এবং অসমের হিন্দু-মুসলমানের সংঘৰ্ষ কেন্দ্ৰিক প্ৰব্ৰজনের প্ৰক্রিয়াকে সমাধান করার জন্য ১৯৫০ সনের ৮ এপ্ৰিল নেহরু লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ এই চুক্তি মতে দুই সীমান্তবৰ্তী দেশের বহু লোকের যাতায়ত ঘটেছিল৷ কিন্তু গুরুত্বপূৰ্ণ বিষয় হলো - সেই সাম্প্ৰদায়িক সংঘাতের সময় যাঁরা প্ৰাণ হারালেন, যাঁরা চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেলেন, তাঁরা পরবৰ্তী কালে কোন ন্যায় পেয়েছিলেন কি ? ভারতীয় গণতন্ত্ৰ তাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে সক্ষম হয়েছিল কি ? এই প্ৰগুলোর উত্তর কোনকালেই ইতিবাচক নয়৷ দুঃখের বিষয়, সেই সংঘৰ্ষের ফলে পূৰ্ব পাকিস্তান থেকে নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে আসা বাংলা ভাষি হিন্দুরা পরবৰ্তী পৰ্যায়ে অসমে সন্দেহযুক্ত নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত হয়৷ এমনকি সেই সংঘৰ্ষে আহত-নিহত লোকের উত্তরপুরুষরা অসমে সন্দেহযুক্ত নাগরিক হিসাবে পরিগণিত হয়৷ অৰ্থাৎ ১৯৫০ সনের সংঘৰ্ষে নিৰ্যাতিত লোকেদের বিগত পঞ্চাশ বছরেও ন্যায় প্ৰদান করা হয়নি৷ শুধু তাই নয়, নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি অনুসারে ধৰ্মীয় বা ভাষিক সংখ্যালঘু যারা পাকিস্তান (পূৰ্ব) ছেড়ে এদেশে এসেছিলেন তাঁদের অনেকরই নাম সেই সময়ের নাগরিকপঞ্জীতে অন্তৰ্ভূক্ত হয় নি৷ ফলে তাদের সামনে ভারতীয় নাগরিকত্ব লাভের বিষয়টি একটি ‘সন্ত্ৰাসের নাম’ মাত্ৰ৷ উল্লেখ্য নেহেরু-লিয়াকত চুক্তির পর অসমে প্ৰব্ৰজন করা বহু পূৰ্ববঙ্গীয় মূলের লোক সম্প্ৰতি সন্দেহযুক্ত নাগরিক হিসাবে বা বিদেশী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে পড়েছেন৷ বৰ্তমান অসমে রাষ্ট্ৰীয় নাগরিকপঞ্জী উন্নীতকরণের কাজ অব্যাহত আছে৷ সেই প্ৰক্রিয়ায় যাবতীয় নথিপত্ৰ দিতে না পেরে তাঁরা আত্মহত্যার পথকেই বেছে নিতে বাধ্য হছেন৷ অৰ্থাৎ ১৯৫০ সনের সংঘৰ্ষের পরিণতি স্বরূপে আসা ভাষিক বা ধৰ্মীয় সংখ্যালঘু এবং স্বাধীনতার পূৰ্বে অসমে বসবাস করতে আসা এই দুই শ্ৰেণীর একাংশকে বিগত দিনে বিভিন্ন প্ৰকার নিৰ্যাতনের সন্মুখীন হতে হয়েছে৷ অথচ এই নিৰ্যাতন বা নিপীড়নের ভূক্ত ভোগীরা এদেশে যে ভাবে গণতান্ত্ৰিক ন্যায় লাভ করার কথা সেভাবে তা সম্ভবই হয়নি৷

রাজ্য ভাষা আন্দোলন এবং তার পরবৰ্তী পৰ্যায় :

অবিভক্ত কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চলের বেতনা, হাজলপারা, গোরেশ্বর ইত্যাদি অঞ্চলের ভাষিক সংখ্যালঘু সমাজের পংকজ বিশ্বাস অন্যতম৷ এই পঙ্কজ বিশ্বাস তাঁর কিশোরকালে তৎকালীন উগ্ৰ জাতীয়তাবাদী অসমীয়া ভাষীদের আক্রমনের বলি হয়েছিলেন৷ সেটা রাজ্যভাষা আন্দোলনের সময়কার ঘটনা৷ শুধু পংকজই নন, ব্ৰহ্মপুত্ৰ উপত্যকার বহু বাঙালি হিন্দু ‘জাতীয়তাবাদী অসমীয়া’র আক্রমনের বলি হয়েছিলেন৷ এরকম আক্রমনের সন্মুখীন হওয়া লোকের সংখ্যা সহস্ৰাধিক৷ মারাত্মক ভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন নিম্ন অসমের একাংশ ভাষিক সংখ্যালধু লোক৷ কিন্তু সেই হতভাগ্য লোকেরা আজও কোন বিচার পেলেন না, হলনা সঠিক তদন্ত৷ কিন্তু আন্দোলনে মৃত্যু হওয়া এক বিশেষ শ্ৰেণীর লোক লাভ করলেন শহীদের স্বীকৃতি৷ সেদিক থেকে শিলচরে ভাষা আন্দোলনে মৃত্যু বরণ করা মাতৃভাষা প্ৰেমীদের কথা উল্লেখ করা প্ৰয়োজন৷ বাংলা ভাষার হকে শিলচরে প্ৰতিবাদী জনতার ওপর শাসক দলের বৰ্বরোচিতে আক্রমণে প্ৰাণ হারাণো, শহীদ বা তাঁদের পরিবার প্ৰকৃত অৰ্থে ন্যায় লাভ করেছে কি ? এই প্ৰতিবেদক সহ কয়েকজনের একটি দল ওই সব হতভাগ্য পরিবারের বৰ্তমান অবস্থার খোঁজখবর নিতেগিয়ে দেখা গেল - দিন মজুরি না করলে এই সমস্ত শহীদের পরিবারে উনুন জ্বলে না৷ (এই সন্দৰ্ভে ২০০৮ সনে ‘সাদিন’ পত্ৰিকায় বিস্তত প্ৰতিবেদন প্ৰকাশ পেয়েছিল৷) কিন্তু আজ এই অবস্থা কেন ? এখানে অবশ্যই উল্লেখ করা প্ৰয়োজন যে স্বাধীনোত্তর অসমে প্ৰায় প্ৰতি দশ বছর অন্তর অন্তর এক একটা সংঘাতপূৰ্ণ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়ে আসছে৷ জনগণের মধ্যে থাকা বিভিন্ন দ্বন্দ্বকে সমাধানের পরিবৰ্তে হিংস্ৰ সংঘাতে পৰ্যবসিত করছে, আর অগণন লোক এই সংঘাতের বলি হছে৷ উদাহরণ স্বরূপ ১৯৫০ সনের পর শুরু হলো ১৯৬০ এর ভাষা আন্দোলন৷ এর দশ বছর পূৰ্ণ হতে না হতেই দেখা গেল ‘বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধে’র পাশ্বক্রিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটা বছর আগে থেকেই অসমে পূৰ্ববঙ্গ থেকে প্ৰব্ৰজন হয়েছিল তা ছিল এক দুৰ্দশাজনক অধ্যায়৷ প্ৰব্ৰজনের এই সময়কালে অসমে এসে বসবাসকারী বাঙালি হিন্দু, চাকমা, বৌদ্ধ, হাজং, কোচ রাজবংশী শরণাৰ্থীদের অবস্থা ছিল প্ৰাণে বেঁচে পালিয়ে আসা সেই ধৰ্মীয় বা ভাষিক সংখ্যালঘু লোকেরা হাতে প্ৰমাণপত্ৰ নিয়ে অসমে এসে আশ্ৰয় লাভ করে কিন্তু অনেকেই পেল না ভূমির অধিকার৷ অনেক ভাষিক সংখ্যালঘু আছেন যারা ১৯৬৬ সন থেকে আজও আছেন শরণাৰ্থী শিবিরে৷ উদাহরণ স্বরূপ গোৱালপারা জেলার মাটিয়া অঞ্চলে এরকম প্ৰায় নয়টা শরণাৰ্থী শিবির আছে৷ এই নয়টা শিবিরই এখন নয়টা গ্ৰামে রূপান্তরিত হয়েছে৷ এই নয়টি গ্ৰামের পাঁচ সহস্ৰাধিক লোকের আছে পূৰ্ব পাকিস্তান থেকে অসমে প্ৰব্ৰজন করার প্ৰমাণ পত্ৰ৷ কিন্তু যে স্থানে তাদের সংস্থাপিত করা হল সেই ভূমির ওপর তাঁদের নেই প্ৰকৃত অধিকার৷ সেই ভূখণ্ডের পাট্টা তাদের কোনদিনই পাবার নয়৷ অৰ্থাৎ ভোট দান বা আশ্ৰয়ই শেষ কথা - এটাই ‘মানব অধিকার’৷ ষাট সত্তর দশক ধরে সংঘাত জৰ্জর পরিস্থিতির বলি হয়ে আসা এই সংখ্যা সহস্ৰাধিক - যাঁদের মাথার ওপর খোলা আকাশ তো রয়েছে কিন্তু পায়ের তলায় ‘মাটি’ নেই৷

আশীর দশকের রক্তাক্ত দিনগুলো :

১৯৭৮ সন থেকে অসমে উদ্ভত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আছে বহু ইতিবাচক-নেতিবাচক দিক৷ দীৰ্ঘ এই আন্দোলনের পটভূমির ইতিহাস৷ তা পুনরাবৃত্তি করার চাইতে এই আন্দোলনে আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদী কি ভাবে উগ্ৰ-জাতীয়তাবাদ বা হিংসাত্মক জনজাগরণে পরিণত হলো তাই প্ৰধান গবেষণার বিষয়৷ কেননা ‘অসম আন্দোলন’ নামধারী এই জনজাগরণে বিভিন্ন ভাষাভাষী, জাতি ধৰ্ম জনসমষ্টির মধ্যে এমনভাবে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিল বা স্থায়ীভাবে গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের বীজ বপন করল যে তা প্ৰতিহত করা এক বৃহৎ প্ৰত্যাহবান৷ অন্ততঃ অসমের মতো অগণন সমস্যায় জৰ্জরিত রাজ্যটির জন্য এই আন্দোলনে সৃষ্টি করা জনগণের মধ্যে দ্বন্দ্বের নিঃশেষ করাটা কঠিন হবে৷ এই আন্দোলনে সৰ্বাধিক ক্ষতিগ্ৰস্ত হল ধৰ্মীয় ও ভাষিক সংখ্যালঘুরা, সংক্ষেপে বলতে গেলে অসম আন্দোলনের অত্যন্ত নিকৃষ্ট সময় ছিল ১৯৮৩ সনের ফেব্ৰুয়ারী মাস৷ সে সময়ে পরিস্থিতিকে সুস্থির করতে অপারগ কেন্দ্ৰীয় সরকারের সাধারণ নিৰ্বাচনের সিদ্ধান্তই ছিল রক্তাক্ত ফেব্ৰুয়ারীর অন্যতম কারক৷ শুধু তাই নয়, বিদেশী বহিস্কারের নামে ১৯৮৩র ফেব্ৰুয়ারীর প্ৰায় প্ৰত্যেকটা দিনই সংঘটিত হয়েছিল অগণন হিংসাত্মক ঘটনা৷ এখানে সেই হিংসাত্মক ঘটনার বিবরণ দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়৷ কারণ ১৯৮৩ সনের ফ্ৰেব্ৰুয়ারীর উগ্ৰজাতীয়তাবাদী কাণ্ডে কিভাবে আৰ্থ সামাজিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি করেছিল, সেই সন্দৰ্ভে এই প্ৰতিবেদক ইতিমধ্যে তিনটি গ্ৰন্থে (নেলী, ১৯৮৩ ‘চাউল খোৱা, ১৯৮৩’ এবং ‘১৯৮৩ র অসমত নিপীড়িত বাঙালী’ প্ৰকাশক একলব্য প্ৰকাশন) বিস্তত ব্যাখ্যা করা হয়েছে৷ তবে এখানে উল্লেখ করা প্ৰয়োজন যে ১৯৮৩ সনের ফেব্ৰুয়ারীতে উগ্ৰ জাতীয়তাবাদী অসমীয়ার আক্রমণের বলি হয়েছিলেন হাজার হাজার ধৰ্মীয় এবং ভাষিক সংখ্যালঘু জনতা৷ তদানীন্তন নগাঁও জিলার নেলীতে (প্ৰায় ১৬ টি গ্ৰামে একই সময়ে আক্রমণ চালানো হয়) প্ৰায় ৩০০০ ধৰ্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্ৰদায়ের লোকের মৃত্যু হয়েছিল অসম আন্দোলনের নেতা-কৰ্মী সমৰ্থক বাহিনীর সশস্ত্ৰ আক্রমণে৷ এই ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল ১৯৮৩ সনের ১৮ ই ফেব্ৰুয়ারী৷ তার আগে ১৪ এবং ১৫ ফেব্ৰুয়ারী দরং জেলার চাউলখোয়ায় চাপরির দশটিরই অধিক গ্ৰামে অসমীয়া ভাষীর আক্রমণ চলেছিল৷ ফলে পাঁচ শতাধিক লোক নিহত এবং সহস্ৰাধিক লোক আহত হয়েছিলেন৷ চাউল-খোয়া চাপরিতে ধৰ্মীয় এবং ভাষিক সংখ্যালঘু উভয়েই আক্রান্ত হয়েছিলেন৷ কারণ একটাই এই দুইশ্ৰেণীর লোকের মুখের ভাষা বাংলা, একইভাবে ১৮ ফেব্ৰুয়ারীতে কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চল, দরং জেলার (বৰ্তমান ওদালগুরি) খৈরাবারী, রামপুর ইত্যাদি অঞ্চলে বহু লোক আক্রান্ত হয়েছিলেন৷ অন্যদিকে ১৯, ২০, ২১ ফেব্ৰুয়ারী ধেমাজী জেলার বিলাসীপাড়ার নিকটবৰ্তী বৃহত্তর আৰ্গে চাপরি অঞ্চল, মাজরবারী, রামনগর, কাকোবারী, টঙালী-নলবারী, চিমেন চাপরি ইত্যাদি অঞ্চলে মিসিং জনগোষ্ঠীর একাংশ লোক এবং অসম আন্দোলনের সমৰ্থক বাহিনীর লোকেরা ‘বিদেশী খেদাও’র নামে বঙ্গভাষীর ওপর আক্রমণ চালায়৷ একইভাবে ধেমাজী শহরের নিকটবৰ্তী বিষুপুর, শান্তিপুর ইত্যাদি অঞ্চলেও বাংলাভাষী লোকের ওপর আক্রমণ চলে৷ ফলে কয়েক শতাধিক লোক প্ৰাণ হারিয়েছিলেন৷ চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়েছিলেন বহু লোক৷ মিসিলা নমসূদ্ৰ নামে আৰ্গে রামনগর গ্ৰামের একজন মহিলা এখনও আছেন, যাঁর একটি পা কেটে ফেলেছিল আক্রমণকারীরা, পরম মালোদাস নামের মাজবারী গ্ৰামের এক যুবক আছেন যার একটি হাত কেটে নিয়েছিল উগ্ৰজাতীয়তাবাদী অসমীয়া লোক৷ একই ভাবে ফেব্ৰুয়ারী মাসে লক্ষিমপুর জেলার বাধকরা অঞ্চলে অৰ্ধশতাধিক লোককে হত্যা করা হয় জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বেশ কয়েকটি গ্ৰাম৷ মোট কথা ১৯৮৩ সনের ফেব্ৰুয়ারীতে সমগ্ৰ বাংলাভাষী হিন্দু এবং বঙ্গীয় মূলের মুসলমানের ওপর খাড়া নেমে এসেছিল ‘বিদেশী খেদাও’ নামে৷ কিন্তু প্ৰ হলো - এই ভুক্তভোগী লোকগুলো ন্যায় লাভ করেছিলেন কি ? অন্তত নেলী গণহত্যা সম্পৰ্কীয় ছয়শতাধিক গোচর সমূহের বিচার প্ৰক্রিয়াকে আজ পৰ্যন্ত ন্যায়ালয়ের দরজায় গিয়ে পৌঁছাতে দিল না সরকার৷ অৰ্থাৎ ভুক্তভোগী বা নিৰ্যাতিত শ্ৰেণীর ন্যায়প্ৰাপ্তির অধিকারকে শাসকীয় পক্ষই নস্যাৎ করে দিছে৷ রাষ্ট্ৰসংঘের দ্বারা প্ৰদত্ত মানব অধিকার সনদকেই বুড়ো আঙুল দেখাছে ভারতীয় রাষ্ট্ৰযন্ত্ৰ৷

১৯৮৩ র পরের সংখ্যালঘু নিধনপৰ্ব :

কুড়ি শতিকার শেষের দশকে এবং তার পরের একবিংশ শতিকায় অসমের এক বিশেষ অঞ্চলে ধৰ্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্ৰদায়ের ওপর নিৰ্বিচারে আক্রমণ চালিয়েছিল বড়ো উগ্ৰ-জাতীয়তাবাদী শক্তি৷ ১৯৯৩ এবং ১৯৯৪ সনে অবিভক্ত বরপেটা, বঙ্গাইগাঁও এবং কোকরাঝার জেলার বিভিন্ন প্ৰান্তে ধৰ্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্ৰদায়ের ওপর বেশ কয়েকবার আক্রমণ চালায় বড়ো উগ্ৰপন্থীরা৷ মৃত্যু হয় প্ৰায় পাঁচ শতাধিক লোকের এবং ঘরবারি হারায় অৰ্ধলক্ষাধিক মানুষ৷ এমনকি ১৯৯৪ সনে বরপেটা জেলার বাঁশবারি অঞ্চলের আশ্ৰয় শিবিরে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করে মারা হয় বহু লোককে৷ সরকারের দেওয়া আশ্ৰয় শিবিরে থাকা লোকগুলোকে নিরাপত্তা দিতে ব্যৰ্থ অসম সরকারের জন্য এটা ছিল চরম লজ্জাজনক বিষয়৷ বলা বাহুল্য যে, সে সময় থেকে আজপৰ্যন্ত বেশ কয়েকটি পরিবার আশ্ৰয় শিবিরে বসবাস করছে৷ ১৯৯৩-৯৪ সনে পিতৃ-মাতৃ হারা শতাধিক শিশু অনাথ হয়ে পরে এবং এই অনাথ শিশুদের অনেকেই কাছার জেলার বাঁশকান্দি মাদ্ৰাসায় শিক্ষা গ্ৰহণ করে৷ এই নিৰ্যাতিতদের পুনসংস্থাপনে, ক্ষতিপূরণ তথা ন্যায় বিচার দিতে সম্পূৰ্ণ ব্যৰ্থ সরকার৷

এই ঘটনার পর ২০০৮ সনের ২ অক্টোবর থেকে দরং-ওদালগুরি জেলায় ধৰ্মীয় সংখ্যালঘু এবং বড়ো জনগোষ্ঠীর মধ্যে শুরু হয় সাম্প্ৰদায়িক সংঘাত৷ শতাধিক লোক প্ৰাণ হারাণো এই সংঘাতে বহু সংখ্যালঘুকে নিহত হতে হয়েছে বড়ো উগ্ৰপন্থীর হাতে, ধ্বংসপ্ৰাপ্ত হয় অৰ্ধশতাধিক গ্ৰাম, একইভাবে ২০১২ সনের ১৯ জুলাইর মাঝরাত থেকে কোকরাঝার, চিরাং, বঙ্গাইগাঁও এবং ধুবরী জেলার একাংশে ছড়িয়ে পরে বড়ো মুসলিম সাম্প্ৰদায়িক সংঘাত৷ এই সংঘৰ্ষে শতাধিক লোক প্ৰাণ হারায় এবং প্ৰায় চার লক্ষাধিক লোককে আশ্ৰয় নিতে হয় শিবিরে৷ কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, আজ পৰ্যন্ত সেই আক্রান্ত লোকেরা নিজেদের বাড়িঘরে ফিরতে পারেন নি, এমন কি শুরু হয়নি কোন বিচার প্ৰক্রিয়া, এক কথায় দোষীকে খোলা আকাশের নীচে মুক্ত ছেড়ে দেওয়া হয়েছে৷ অন্যদিকে ২০১৪ সনের পয়লা এবং ২য় মে বাকসা জেলার নারায়ণগুরি, খাগ্ৰাবারী অঞ্চলে বড়ো উগ্ৰপন্থীর নৃশংস আক্রমনের বলি হয় অৰ্ধশতাধিক মুসলমান লোক৷ পূৰ্ববঙ্গের এই ধৰ্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্ৰদায়ের ওপর চালানো এই আক্রমনের পিছনে বড়ো উগ্ৰপন্থী সংগঠন এন ডি এফ বি (সংবিজিত গোট) জড়িত আছে বলে আরক্ষী তদন্তে প্ৰকাশ৷ কিন্তু আশ্চৰ্যের বিষয় এই গুরুতর অপরাধ্বে কোনও শাস্তি বিধান হয়নি আজও৷ যদিও নিহত এবং আহতের পরিবারকে সরকার ক্ষতিপূরণ দিয়েছে কিন্তু অপরাধীদের করায়ত্ব করতে আজও সক্ষম হয়নি সরকার৷ উপরন্তু হত্যাকারী উগ্ৰপন্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার পোষকতা করেছে, বরং অজস্ৰ সংখ্যালঘুর রক্তে হোলী খেলার ‘মূলসুঁতি’দের নিয়ে মিলিজুলি সরকার গঠন করেছে কংগ্ৰেস-বিজেপি উভয় দলই৷ শুধু তাই নয় বিজেপি দলের একাংশ নেতা-মন্ত্ৰী-বিধায়ক ও পূৰ্বের রক্তাক্ত অসম আন্দোলনের নেতা৷ যে আন্দোলন কেড়ে নিয়েছিল সহস্ৰ ধৰ্মীয় ও ভাষিক সংখ্যালঘুর প্ৰাণ৷

মানব অধিকার, ন্যায়ের দরজা কোথায় :

বেঁচে থাকার অধিকার বিগতকালে অসমে এমনভাবে খৰ্ব করা হয়েছে যে, তার এক ভয়ানক পরিণতি ভোগ করছে অসমে বসবাসকারী ধৰ্মীয় ভাষিক সংখ্যালঘুরা, অসংখ্য লোককে উগ্ৰ-জাতীয়তাবাদী, উগ্ৰপন্থী বা গোষ্ঠীসাফাই অভিযানের বলি হতে হয়েছে৷ এদিকে সরকারি পক্ষ থেকেও চরম অবজ্ঞার বলি হয়েছে৷ কিন্তু পবিতাপের বিষয় এই যে, একটার পর একটা জঘণ্য ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের যেভাবে বিচার হওয়া দরকার ছিল, বা আইন মতে শাস্তি প্ৰদান করার কথা ছিল তা আর হয়নি৷ নেলী, অৰ্ণেই চাপরি, বিষুপুর, শান্তিপুর, গোরেশ্বর, চাউল খোয়া বা মোকালমুয়ার গণহত্যার বলি হওয়া, ১৯৯৩-৯৪ সনের বরপেটা, বঙ্গাইগাঁও এ নিৰ্যাতিতদের উপযুক্ত ন্যায় লাভ না করাটা এটাই প্ৰমাণ করে যে, ‘সংখ্যালঘুর নিপীড়িত শ্ৰেণী’ সরকারী ভাবেও বঞ্চিত বা অবহেলিত৷ বেঁচে থাকার অধিকার থেকে শুরু করে ন্যায় প্ৰাপ্তির অধিকার পৰ্যন্ত-সংখ্যালঘু লোকের ক্ষেত্ৰে উলঙ্ঘন করাটা অসমে এক পরম্পরায় পরিণত হয়েছে৷ এই বিশেষ শ্ৰেণীর মানুষের জন্য মানব অধিকারের দরজা খোলা হবে কবে ?

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.